সংগৃহীত ছবি
অনলাইন ডেস্ক : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, “আপনারা সবাই জানেন যে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে একটি আবেদন করেছিলাম। ওই আবেদনে বলা হয়েছিল, শেখ হাসিনা ও গাইবান্ধা জেলার আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলের মধ্যে টেলিফোন বা জুমের মাধ্যমে একটি কথোপকথন হয়। ওই কথোপকথনে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী ২২৭ জনকে হত্যা করার লাইসেন্স পেয়েছেন এবং যারা আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলার জন্য দায়ী, তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত কর্মকর্তাদের হুমকি দেন এবং বলেন তাদের একটি তালিকা তৈরি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে চাকরি করতে হলে তা মাথায় রাখতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই কথোপকথনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশের অন্যান্য আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আমরা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ১১(৪) ধারা অনুযায়ী আদালত অবমাননার মামলা করি। আদালত আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে শেখ হাসিনা এবং শাকিল আকন্দ বুলবুলকে শোকজ নোটিশ পাঠান এবং তাদের উপস্থিত হয়ে অভিযোগের জবাব দিতে বলেন।”
“নির্দিষ্ট ঠিকানায় নোটিশ পাঠানো হলেও তারা কেউ হাজির হননি। এরপর আদালত দুটি জাতীয় পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের নির্দেশ দেন, কিন্তু তবুও তারা অনুপস্থিত থাকেন। পরে আদালত তাদের পক্ষে ডিফেন্স লয়ার নিয়োগ দেন এবং একজন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন। আজ এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রসিকিউশন, অ্যামিকাস কিউরি এবং স্টেট ডিফেন্স লয়ার সবাই তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেন।”
প্রসিকিউটর জানান, “আমরা আমাদের বক্তব্যে বলেছি, উক্ত কথোপকথনের রেকর্ডিং সিআইডির মাধ্যমে ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়েছে। সিআইডি নিশ্চিত করেছে, রেকর্ডকৃত কণ্ঠ দুটো যথাক্রমে শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ বুলবুলের। এটি কোনো এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট নয়, বরং একটি আসল কথোপকথন। প্রথমে এটি ‘দৈনিক কালবেলা’ পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত হয় এবং এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যম এটি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে।”
“আদালত সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট এবং উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্ক পর্যালোচনা করে রায় দেন। আদালতের মতে, শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে মামলার বাদী, সাক্ষী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংসের হুমকি দিয়েছেন। এটি বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ১১(৪) ধারা অনুযায়ী আদালত অবমাননার শামিল।”
আদালত এই অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং শাকিল আকন্দ বুলবুলকে ২ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। আদালত নির্দেশ দেন, তারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলে সেদিন থেকে অথবা গ্রেপ্তার হলে সেদিন থেকে এই সাজা কার্যকর হবে।
প্রসিকিউটর বলেন, “এই কথোপকথনে বলা ২২৭ জন ব্যক্তি প্রথমে থানায় মামলা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, রংপুরের আবু সাঈদের হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি এখন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। তদ্রূপ, চানখারপুলে ছয়টি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ের হওয়া মামলাগুলোতেও শেখ হাসিনার নাম আসামি হিসেবে আছে এবং সেই মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালে এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই হুমকির কারণে অনেক সাক্ষী এখন সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন এবং নতুন বাদীরাও মামলা করতে সাহস করছেন না। এটি বিচারপ্রক্রিয়ায় বড় বাধা সৃষ্টি করছে। আদালত আমাদের দাখিল করা প্রমাণ ও দলিলাদি যথাযথ মনে করেছেন এবং বলেছেন, এটি প্রশাসনের ওপর আক্রমণের শামিল ও ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ জাস্টিস’-এর পথ রুদ্ধ করার মতো অপরাধ।”
সবশেষে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “আমরা ভীত নই। আইন অনুযায়ী আমরা কাজ করবো। তবে আমরা আমাদের সাক্ষীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তারা যদি ভয় পান, তবে মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এই কারণেই কনটেম্পট প্রসিডিংস আনা হয়েছিল।”